ছোটদের জন্য লেখা : জাফর ইকবাল (পর্ব-২)

প্রথম প্রকাশঃ এপ্রিল ৯, ২০১৫ সময়ঃ ১:৩৯ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১২:৪১ অপরাহ্ণ

5বইপড়ার কারণে মানুষের জীবনে কী অসাধারণ ঘটনা ঘটতে পারে সেটা আমি আমার নিজের চোখে দেখেছি। মনোবিজ্ঞানী বা বিজ্ঞানী গবেষকরা হয়তো এটা আগে থাকতেই জানেন– আমরা জানতাম না এবং আমার স্ত্রীর কারণে এটা হঠাৎ করে আমরা আবিষ্কার করেছিলাম। বিষয়টা বোঝানোর জন্যে একেবারেই আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনা বলতে হবে, আগেই সে জন্যে সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

আমি আর আমার স্ত্রী দুজনেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মোটামুটি একই সময়ে পিএইচডি শেষ করেছিলাম। যখন পোস্ট-ডক করছি, তখন আমাদের প্রথম পুত্রসন্তান জন্ম নেয় এবং আমার স্ত্রী কোনো চাকরি-বাকরি না করে ঘরে বসে আমাদের ছেলেটিকে দেখেশুনে রাখার সিদ্ধান্ত নিল। কয়েক মাসের একটা বাচ্চাকে নানাভাবে ব্যস্ত রাখার একটি প্রক্রিয়া হিসেবে সে আমাদের ছেলেটিকে বই পড়ে শোনাতে শুরু করল।

প্রথম প্রথম সে বইটি টেনে নিয়ে সেটাকে দিয়ে কোনো এক ধরনের খেলা আবিষ্কারের চেষ্টা করলেও, আট মাস বয়স হবার পর হঠাৎ করে সে বইয়ের দিকে নজর দিতে শুরু করল। আমরা মোটামুটি বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলাম, দুরন্ত ছটফটে একটা শিশুকে খুব সহজেই বই পড়ে শুনিয়ে শান্ত করে ফেলা যায়।

আমাদের ছেলের বয়স যখন আড়াই বছর, তখন আমাদের মেয়ের জন্ম হয় এবং আমার স্ত্রী তার দুই ছেলেমেয়েকে দুই পাশে শুইয়ে বই পড়ে যেতে লাগল। দুইজন ছোট শিশু তাদের মায়ের দুই পাশে শুয়ে গম্ভীরভাবে বইপড়া শুনে যাচ্ছে, দৃশ্যটি খুব মজার। আমি বেশ অবাক হয়ে সেটি উপভোগ করতাম।

আমার ছেলের বয়স যখন ঠিক চার বছরের কাছাকাছি, তখন আমাদের একজন আমেরিকান প্রতিবেশী তার ছেলের জন্মদিনে আমাদের ছেলেকে দাওয়াত দিয়েছে। বিকেল বেলা গাড়ি করে বাসা থেকে তুলে নিয়ে কয়েক ঘন্টা পর ভদ্রমহিলা আমাদের ছেলেকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে যাবার সময় আমার স্ত্রীকে বলল, “তুমি তো আমাকে কখনও বলনি যে, তোমার ছেলে সবকিছু পড়তে পারে।”

আমার স্ত্রী আকাশ থেকে পড়ল; বলল, “না, আমার ছেলে মোটেও পড়তে পারে না, তাকে আমরা একটা অক্ষরও পড়তে শেখাইনি।”

আমেরিকান ভদ্রমহিলা বলল, “আমার কথা বিশ্বাস না হলে তুমি পরীক্ষা করে দেখ। জন্মদিনে আমার ছেলে অনেক গিফট পেয়েছে, গিফটগুলো জুড়ে দেবার জন্যে সাথে যে ইন্সট্রাকশান শিট ছিল, তোমার ছেলে সেটা পড়ে পড়ে শুনিয়েছে, অন্য সব বাচ্চা মিলে তখন সেগুলো জুড়ে দিয়েছে।”

আমেরিকান ভদ্রমহিলা চলে যাবার সাথে সাথে আমার হতবাক স্ত্রী একটা সিরিয়ালের বাক্স নামিয়ে আমার ছেলের হাতে দিয়ে বলল, “এখানে কী আছে পড় দেখি।” আমার ছেলে গড়গড় করে সেটা পড়ে শোনাল। আমার স্ত্রী একটা শব্দ দেখিয়ে বলল, “এটা বানান কর দেখি।” আমার ছেলে ফ্যাল ফ্যাল করে আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইল, ‘‘বানান? সেটা আবার কী?’’

আমার স্ত্রী একটু পরেই আবিষ্কার করল, সে একটা অক্ষরও চিনে না, কোনটা কোন অক্ষর জানে না, কিন্তু সবকিছু পড়তে পারে। আমি নিজের চোখে না দেখলে এটা বিশ্বাস করতাম না যে, একজন মানুষ কোনো অক্ষর না জেনে পুরোপুরি পড়ে ফেলতে পারে। অনেক পরে সে যখন স্কুলে গিয়েছে তখন সে এ-বি-সি-ডি শিখেছে!4

অনেকের ধারণা হতে পারে, আমি খুব সূক্ষ্মভাবে আমার ছেলেকে অসাধারণ একজন মেধাবী শিশু হিসেবে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি। কারণ এটা মোটেও সে রকম কিছু নয় এবং আমার মেয়ের বেলাতেও হুবহু সেই একই ব্যাপার ঘটেছে।

এটা হওয়া সম্ভব জানার পর আমি সবাইকে এটা বলেছি। যারা আমাদের কথা বিশ্বাস করে তাদের ছোট শিশুদের বই পড়ে শুনিয়েছেন, তাদের সবার বাচ্চা চার বছর বয়সে কিংবা তার আগেই বই পড়তে শিখে গিয়েছে।

আমার কম বয়সী সহকর্মীরা যখন বিয়ে করে এবং যখন তাদের ঘর আলো করে একটা ছোট শিশুর জন্ম হয় তখন আমরা সবার আগে এই তথ্যটি দিই: “একেবারে ছেলেবেলা থেকে তোমাদের বাচ্চাকে বই পড়ে শোনাও; দেখবে কত তাড়াতাড়ি তারা বই পড়তে শিখে যাবে।’’ আমি খুব ছোট বাচ্চাদের জন্যে রংচংয়ে ছবিসহ কয়েকটা বই লেখারও চেষ্টা করেছিলাম।

কোনো সহকর্মীর সন্তান জন্ম হয়েছে খবর পেলে সেই বইগুলোর এক দুইটিও তাদের হাতে ধরিয়ে দিই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অবধারিতভাবে শিশুদের বাবা কিংবা মা কিছুদিন পর আমার কাছে আরেক কপি বই নিতে আসেন। সব সময়েই দেখা যায়, শিশুটিকে অসংখ্যবার একটা বই পড়িয়ে শোনাতে শোনাতে বইটি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। পড়তে পড়তে একটা বই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হওয়ার মতো সুন্দর ঘটনা আর কী হতে পারে!

ছোট শিশু যখন নিজে নিজেই পড়তে শিখে যায়, তখন আরেকটি চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে। এই শিশুটির সময় কাটানো নিয়ে কোনো সমস্যা হয় না। আমরা সবাই নিশ্চয়ই দেখেছি, চার-পাঁচ বছরের একটা বাচ্চাকে নিয়ে মা-বাবাদের খুব ব্যস্ত থাকতে হয়; বাচ্চা ঘ্যান ঘ্যান করে কাঁদছে, প্রথমে আদর করে শান্ত করার চেষ্টা করছেন, তারপর যখন পরিবেশটুকু অসহ্য হয়ে গেছে তখন বাচ্চাকে বকুনি দিচ্ছেন, বাচ্চা আরও জোরে গলা ফাটিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে– এ রকম দৃশ্য কে দেখেনি?

কিন্তু একটা শিশু যখন পড়তে শিখে যায় তখন আর এই সমস্যা হয় না; শিশুটির হাতে একটা মোটা বই ধরিয়ে দিতে হয়, শিশুটি গভীর মনোযোগে সেই বই পড়তে থাকে। একটি ছোট শিশু গভীর মনোযোগ দিয়ে আকারে তার থেকে বড় একটা বই পড়ছে এর চাইতে সুন্দর দৃশ্য পৃথিবীতে নেই। আমাদের সবার ঘরে ঘরে এই দৃশ্য হওয়া সম্ভব। আমি বাজি ধরে বলছি, নতুন বাবা-মায়েরা পরীক্ষা করে দেখুন। বিফলে মূল্য ফেরত!

সূত্র : ফেইসবুক

প্রতিক্ষণ/এডি/শারমিন

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

সর্বাধিক পঠিত

20G